নড়াইলের ঐতিহ্যবাহী নিশিনাথতলা মন্দিরে হিন্দু ভক্তদের পাকুড়গাছে জলঢালা ও পূজা শুরু

নড়াইলের ঐতিহ্যবাহী নিশিনাথতলা মন্দিরে হিন্দু ভক্তদের পাকুড়গাছে জলডালা ও পূজা। নড়াইলের শ্রীশ্রী নিশিনাথতলা মন্দির’ নড়াইল পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের করিগ্রামে সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের সামান্য দক্ষিণে রাস্তার পাশে প্রাচীন এক পাকুড়গাছের আশ্রয়ে অবস্থিত বহু পুরাতন ও ছোট্ট এক মন্দির। স্থানীয় হিন্দু নরনারীগণ নিয়মিত এখানে পূজা দেয়, পবিত্র জ্ঞানে শ্রদ্ধা জানায় এবং মানত করে। ভক্তেরা বিশ্বাস করে যে, নিশিনাথ ঠাকুর সন্তুষ্ট হলে পাপমোচন হয়, পাকুড়গাছে ইট বেঁধে রাখলে মনোবাসনা পূর্ণ হয়, গাছে দুধ ও জল ঢেলে তার নিচে বসে স্নান করলে রোগমুক্ত হওয়া যায়। এই বিশ্বাস নিয়ে প্রতিবছর বৈশাখ মাসের প্রতি শনি ও মঙ্গলবার এখানে বহু বছর ধরে এই স্নান এবং গাছে জল ঢালায় অংশ নেওয়ার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে থেকে অসংখ্য ভক্ত আসেন এই নিশিনাথতলা মন্দিরে। শ্রীশ্রী নিশিনাথতলা মন্দির, ডাকাত সর্দার নিশিনাথের সাধনার পীঠস্থান, বাংলাদেশের নড়াইল জেলা-সদরে একদা এক ডাকাত সর্দারের সাধনপীঠ সময়ের পরিসরে ভক্তদের শ্রদ্ধায় মহিমান্বিত হয়ে আজ দেবস্থানের মর্যাদায় পুজিত হচ্ছে।

সাধকের নামেই মন্দিরের এবং এলাকার নাম হয়েছে নিশিনাথতলা। স্থানীয় লোকমুখে প্রচলিত নিশিনাথ ডাকাতের কাহিনী সবাইকে মনে করিয়ে দেয় ত্রেতাযুগে রামায়ণের রচয়িতা মহাকবি মহর্ষি বাল্মিকীর কথা, যিনি তাঁর প্রথম জীবনে ছিলেন দুর্ধর্ষ রত্নাকর দস্যু। জনশ্রুতি অনুসারে, বহুকাল পূর্বে এই অঞ্চল ছিল ঘন জঙ্গলাকীর্ণ। পাশেই প্রবাহিত চিত্রা নদী। সেই নদীর তীর দিয়ে পায়পায়ে সৃষ্ট নির্জন পথ ধরে হঠাৎ কোন পথচারী আসলেই সুযোগ বুঝে তার যথাসর্বস্ব লুন্ঠন করত ডাকাতেরা। অনেক সময় খুন করতেও দ্বিধা করত না। তাই এই পথে সাহস করে একাকী চলাচল করত না কেউ। এইসব ডাকাতি হতো এলাকার দুর্ধর্ষ ডাকাত নিশিনাথ সর্দারের নেতৃত্বে। একবার এক বৃদ্ধা নারী একাকী এই পথে যাওয়ার সময় ডাকাত সর্দার নিশিনাথের হাত হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য বুদ্ধি করে উচ্চস্বরে ডাকাতের উদ্দেশ্যে বলে গেল ‘বাবা নিশিনাথ, আমি জামাই বাড়ি যাচ্ছি, পথে আমার যেন কোন বিপদ না হয়। ফেরার পথে আমি তোমার এখানে কিছু মানত দিয়ে যাব’।

এতে বৃদ্ধা নিরাপদে জামাই বাড়ি পৌঁছালে সকলে অবাক হয়ে যায় এবং বৃদ্ধার এই কাহিনীটি মুখে মুখে লোকালয়ে প্রচার হয়ে যায়। এর পর থেকে ঐ পথ দিয়ে চলাচল করার সময় সবাই একইভাবে মানত করে যাওয়া শুরু করে। এর ফলে একসময় নিশিনাথের মনে আসে পরিবর্তন। নিশিনাথ পাপের অনুশোচনা নিয়ে ডাকাতি ছেড়ে দেয়। প্রতিদিন ভোরে চিত্রা নদীতে স্নান করে ওইস্থানে একটি পাকুড় গাছের নীচে সে ঈশ্বরের আরাধনায় মগ্ন হয়। এইভাবে দীর্ঘদিন কঠোর সাধনা করে অনুতাপের আগুনে দগ্ধ হয়ে নিশিনাথ একজন শুদ্ধ সাধক পুরুষে পরিণত হয় এবং একসময় সেই গাছতলাতেই দেহত্যাগ করে। পরে সেখানে নির্মিত হয় ‘শ্রীশ্রী নিশিনাথতলা মন্দির’ এবং এলাকার নাম হয় ‘নিশিনাথতলা’। নিশিনাথ ডাকাতের সেই সাধনাস্থল সময়ের গণ্ডি পার হয়ে আজ স্থানীয় হিন্দু নরনারীর হৃদয়ে ভক্তি ও শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই প্রাচীন পাকুড়গাছ এবং এর নীচের ছোট্ট মন্দিরটি এখন দেবালয়ের মর্যাদায় নিত্যপূজিত।

বিশেষত: বৈশাখ মাসের প্রত্যেক শনি ও মঙ্গলবার ধর্মপ্রাণ হিন্দু নরনারীগণের নিকট মন্দিরের সামনে দিয়ে বয়ে চলা চিত্রা নদীতে স্নান করে ভেজা কাপড়ে নিশিনাথতলার পুরোনো পাকুড়গাছে দুধ ও জল ঢালা পুণ্যের কাজ। তারা এই গাছের গোড়ায় দুধ ও জল দিয়ে পূজা নিবেদন করে, মানত করে, যাদের বাসনা পূর্ণ হয়েছে তারা মানত শোধ করে। প্রতিবছর বৈশাখ মাসে এখানে মেলা বসে। স্থানীয়রা সেই মেলাকে বলে ‘বারের মেলা’ বা ‘নিশিনাথতলার মেলা’।

মেলায় কুটিরশিল্পের বিকিকিনি, সার্কাস, পুতুলনাচ, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও মহানামযজ্ঞ অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজারো ভক্ত আসে পূজা দিতে।



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

preload imagepreload image