নিরাশার অরণ্যে ঘেরা \ তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা প্রায় । মেঘাচ্ছন্ন আকাশ!

পশ্চিমাকাশে থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বাতাসের বেগ বাড়ছে ক্রমশ। বৈশাখের শেষ সময়টায় এমন বিক্ষিপ্ত আবহাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। দীন নাথ সেই কাকডাকা ভোরে ঘর থেকে বেরিয়েছেন। সঙ্গে তার নাতনিটা রয়েছে। অন্ধকার নামার আগে গন্ত্যব্যে পৌঁছাবার আপ্রাণ চেষ্টা। সারাদিন হেঁটে কান্ত। একদিকে বয়সের ভারে নুঁয়ে পড়েছেন।

 

কাঁধের হেচলাটাও বেশ ভারী। পেটে এখনো কোন দানাপানি পড়েনি। গতরাতে রান্না করা ভাতের কিছুটা পান্তা করে রেখেছিলেন। ভোরে পান্তা খেয়ে নাতনিটাকে নিয়ে বেরিয়েছেন। রাতে চিড়ার কৌটা আর গুড়ের থলেটা হেচলায় ঢুকিয়ে রাখতে বললেও নাতনিটার একেবারে খেয়াল নেই । এর জন্য দাদু তাকে পথে বসে বেশ গালমন্দও করেছেন। দীন নাথের আপন বলতে এই নাতনিটা ছাড়া আর কেউ নেই। মা মরা মেয়েটাকে আদর-সোহাগে আগলে রেখেছেন।

 

দীন নাথের একমাত্র মেয়েটিকে পাশের গ্রামে বিয়ে দেন। সন্তান প্রসবের সময় বাচ্চাটাকে রেখে প্রায় বারো বছর আগে সে মারা গেছে ! সেই থেকে কোলে-পিঠে করে নাতনিটাকে বড় করে তুলেছেন। কখনো মা’কে হারানোর সামান্য কষ্ট বুঝতে দেননি ওকে। নাতনিটার সব আবদারই পূরণ করার চেষ্টা করেন । কয়েক দফা বন্যা এলাকায় দুর্ভিক্ষের ছাপ ফেলেছে। সময়টা এখন ভালো যাচ্ছে না কারো। ঘরে ঘরে এক ধরণের হাহাকার চলছে। এলাকায় মঙ্গার আভাস। অনেকেরই দু’বেলা খাবার জুটছেনা। কাজের সন্ধানে কেউ কেউ ছুটছেন অন্যত্র। এই অসময়ে কিছুদিনের জন্য দীননাথ তার এক বন্ধুর বাড়িতে কাটিয়ে আসবেন বলে স্থির করেছেন। এরপর পরিস্থিতি ঠিক হলে বাড়িতে ফিরবেন। এমন সিদ্ধান্ত নিয়েই ঘর থেকে বের হয়েছেন। সামনে আর কিছুটা পথ পেরোলেই সুভদ্রা গ্রাম।

 

এই গ্রামের পশ্চিম পাশ ঘেঁষে গেছে ধবলা নদী। উত্তরে বিশাল এলাকা জুড়ে রয়েছে কস্তরী বন। এই নদী আর বনের কারণে গ্রামটি অন্য জনপদের থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন। দীন নাথের বাল্যবন্ধু নিশীকান্তের বাড়ি এই গ্রামেই। জঙ্গলের ভেতর থেকে বয়ে গেছে পায়ে হাঁটা পথ। এক সময় বুনো জন্তুর ভয়ে এই জঙ্গলের ধারে কাছ্ওে কেউ আসত না। এখন আর জন্তু-জানোয়ার বনে আছে বলে খুব একটা শোনা যায়না। তবে চোর-ডাকেতেরা গ্রাম থেকে তাড়া খেয়ে মাঝেমধ্যে এখানে এসে আত্মগোপন করে থাকে।

 

প্রায় বছর দশেক আগে দীন নাথ শেষ বার এসে গেছেন নিশী কান্তের বাড়িতে। এর পর খুব একটা যোগাযোগ নেই। লোক মুখে জেনেছেন নিশী কান্তের ছেলেরা এখন বড় চাকুরে। বাড়িতে দালান-কোঠা হয়েছে। শেষ বয়সে বন্ধুটা বড় সুখে আছে। তার কাছে গিয়ে নিশ্চয় কয়েকটা দিন আরাম-আয়েসে কাটানো যাবে। এই ভেবে মনে এক ধরণের শান্তনা খুঁজে নেয় সে। নাতনিটার পা একেবারেই চলছে না। এর আগে গায়ের বাইরে কখনো পা রাখেনি সে। সমস্ত দিন হেঁটে কোমল পায়ে ফোসকা পড়ে গেছে। ভোর বেলায় রওনা করার সময় মুখে বেশ হাসি ছিলো তার।

 

বেড়াতে যাওয়ার আনন্দে মুখ থেকে খইয়ের মতো কথা বেরোচ্ছিলো। এখন একবারেই নিশ্চুপ ! দু’ পা ফেলছে তো সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছে। দাদু তাকে বার বার বোঝাতে চেষ্টা করছেন। একটু কষ্ট করে এগিয়ে চলো… ঐতো গ্রাম দেখা যাচ্ছে। গোধূলির আবছা আলোয় সবকিছু যেন মিলেমিশে একাকার। কিছুক্ষণ আগেও বনের ভেতর পাখিদের কোলাহল শোনা গেছে। সকলে এখন নীড়ে ফিরেছে বলে মনে হয়। সমস্ত জঙ্গল জুড়ে নিস্তব্ধতা। যেন এখানেও চলছে সাঁজ বেলার নীরবতা। মাথার উপরে আকাশটা অনেকটা ফর্সা হয়ে এসেছে।

 

এ রাতে ঝড়-বৃষ্টি আর না-ও হতে পারে। জঙ্গলের পথে চলতে গিয়ে দীন নাথের চোখের সামনে অতীতের কিছু স্মৃতি ভাসতে লাগল। বিয়ের পর স্ত্রী’কে নিয়ে শশুরালয়ে যাবার কালে পথ ভুলে একবার জঙ্গলেই রাত্রি যাপন করতে হয়েছিলো তাকে। বিয়ের দু’চার বছর ঘর-সংসার করার মধ্যেই মরে গেল বউটা। কলেরাই কাল হল তার জীবনে। দীর্ঘ চলি­শটি বছর কেটে গেছে একাকীত্ব। এখন নাতীটাই তার একমাত্র সঙ্গী। এক সময় সাজানো সংসার ছিলো। এলাকায় তাদের নামডাকও ছিলো বেশ। গাঁয়ের লোকজনের সমাগম ছিলো বাড়িতে। সন্ধ্যায় গানের আসর বসত। ছেলে-বুড়ে সকলেই ছুটে আসত সেখানে। কিন্তু দীন নাথের স্ত্রীর মৃত্যুর পর থেকে সংসারে সবকিছুই ওলট-পালট হয়ে যায়। সন্ধ্যা ঘনিয়ে তখন আঁধার নেমে এসেছে। জোনাকিরাও ঘুরে ঘুরে জানান দিচ্ছে তাদের উপস্থিতি। দক্ষিণা বাতাস এসে বনের কাছে ধাক্কা খাচ্ছে।

 

বনের ভেতর থেকে কানে ভেসে আসছে শেয়ালের হাঁক। নিশাচর পাখিরাও বেরিয়ে পড়েছে আহারের সন্ধানে। জঙ্গলের অদূরে একটি টঙ ঘরে প্রদীপের আলো জ্বলছে। হয়তো পাহারার কাজে কেউ এসেছে বলে মনে হয়। ধীর পায়ে নাতনিতার হাত ধরে দীন নাথ ওই টঙ ঘরের সামনে গিয়ে হাজির হলেন। নিশী কান্তের বাড়িটা কোন দিকে হয়তো ওই পাহারাদার বলে দিতে পারবেন। দীননাথ কাউকে ডাকদিতেই ওই ঘর থেকে প্রদীপ হাতে ষাটোর্ধ এক বৃদ্ধ বেরিয়ে এলেন। তিনি খুব নিচু স্বরে বলে­ন কোথা থেকে এসেছেন ? বসুন। কোন উত্তর না দিয়ে দীননাথ খানিকণ নীরবে দাঁড়িয়ে রইলেন। প্রদীপের আলোয় ওই বৃদ্ধের দিকে বার বার পলক করছিলেন।

 

সেই পরিচিত মুখ, চেনা সুর। যদিও গোঁফ-দাড়িতে ঢেকে আছে ওই বৃদ্ধের মুখমণ্ডল। কিন্তু দীননাথের চিনতে একট্ওু ভুল হলনা ওই লোকটিকে। একটাই প্রশ্ন বার বার মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগলো- নিশীকান্ত এখানে কেন ? নাতনিটার হাত ধরে দীননাথ ওই টঙ ঘরের উপর গিয়ে বসলেন। এর পর লোকটি হাত থেকে আলোটি নিচে নামিয়ে রাখলেন। দু’জন দু’জনার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন অপলক দৃষ্টিতে। দীননাথ প্রশ্ন তোলার আগেই নিশী কান্ত মাথা নিচু করে বলেলেন, ভাগ্যের খেলায় আমি হেরে গেছি। সবকথা শুনে দীননাথের মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়ল। দীননাথের তিন কুলে কেবলমাত্র নাতীটা ছাড়া কেউই নেই বললে চলে। নিশী কান্তের ছেলেরা বড় চাকরি করে। অর্থের অভাব নেই। বাড়িতে দালান-কোঠা তৈরি হয়েছে। যথারীতি কাজের লোক আছে বাড়িতে। অথচ তার জন্য একটু থাকার জায়গা নেই সেখানে।

 

লোকের বাড়িতে কাজ করে ছেলেদের মানুষ করে তুলেছেন। জঙ্গলের পাশের এই টঙ ঘরটি হয়েছে এখন তার শেষ ঠিকানা। আজ শেষ বয়সে বৃদ্ধ বাবাকে বাড়ি থেকে চলে আসতে হলো কেন ? এমন অসংখ্য প্রশ্ন দীননাথের মাথার ভেতর গোলক ধাধার মতো ঘুরপাক খেতে লাগলো। বন্ধুর বাড়িতে দু’দিন আরাম-আয়েসে কাটাবে বলে এতোটা দূর থেকে ছুটে আসা। অথচ এসব বিষয় জানার পর সে স্বপ্নটা মুহূর্তে ভেঙে খান খান হয়ে গেল। সারাদিনের ক্নান্তি ও ক্ষুধা-তুষ্ণায় চোখ আড়ষ্ট হয়ে আসছে। এ সময় নিশী কান্তের দু’চোখ বেয়ে অবিরত ধারায় অশ্র“ গড়িয়ে পড়ছে। দীননাথও চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না। এতোক্ষণে নাতীটা দীন নাথের পায়ের কাছে ঘুমিয়ে গেছে।

 

বাড়ি থেকে বেরনোর পথে কেউ একজন নাতীটাকে একটা পাকা আম খেতে দিয়েছিলেন, যেটি এখনো তার হাতের মুঠোয় ধরে আছে। কোন সাড়া নেই তার। দাদুর সঙ্গে জঙ্গলের এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে একবারেই কান্ত হয়ে পড়েছে সে। সন্ধ্যায় গাঁয়ে সারি সারি যে আলোগুলি জ্বলছিলো সেগুলি এখন আর নেই। টঙ ঘরের চারিপাশে জোনাকিরা নেচে নেচে খেলা করছে। আকাশ জুড়ে তারাদের লুকোচুরি খেলা চলছে। ধবলা নদীর ঢেউগুলি হয়তোবা তখন আঁছড়ে পড়ছে ক‚লে। কস্তুরি বনে কোন রাতজাগা পাখি হয়তো বসে আছে সকাল হবার প্রতীায়। পৃথিবীটা মনে হয় তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মুখোমুখি বসে থাকা এ দুই বাল্যবন্ধুর ক্রন্দন যেন কেউই শুনতে পাইনি।



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked as *