প্রিন্ট এর তারিখঃ জানুয়ারী ১৩, ২০২৫, ৫:৪১ পি.এম || প্রকাশের তারিখঃ ডিসেম্বর ১৫, ২০২১, ৯:১৫ অপরাহ্ণ
১৬ ই ডিসেম্বর ৫০ বছর পূর্তি মহান বিজয় দিবসে “মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিকথা”
বাগেরহাটের মোল্লাহাটের মহান বিজয় দিবসের ৫০ বছর পূর্তিতে মোল্লাহাটের ভূমিকা অপরিসীম। বিজয় দিবস বাংলাদেশে বিশেষ দিন হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে দেশের সর্বত্র পালন করা হয়। প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশে দিনটি বিশেষভাবে পালিত হয়।
১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি প্রকাশিত এক প্রজ্ঞাপনে এই দিনটিকে বাংলাদেশে জাতীয় দিবস হিসেবে উদ্যাপন করা হয় এবং সরকারীভাবে এ দিনটিতে ছুটি ঘোষণা করা হয়। ৯ মাস যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় ৯১,৬৩৪ সদস্য বাংলাদেশ ও ভারতের সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। এর ফলে পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামে একটি নতুন স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে।
১৯৭১ সালে ২৫ শে মার্চে শেখ মুজিবুর রহমান‘র ভাষন দেওয়ার পরে ২৬শে মার্চে পাকিস্তানের নেওয়াজি শেখ মুজিবুর রহমান কে পাকিস্তানে আটক করে। আমরা ৩০ শে মার্চে ফহমের মাধ্যমে ভারতে যাই। মোল্লাহাটের দারিয়ালা বাজার থেকে বর্দে,ইতনে,কর্ফা,বয়েটিগ্রাম থেকে পানিঘাটা তারপর কালনা হতে সি এম বি থেকে বাগদা বর্ডা থেকে বশিরহাট রিক্রুটিং অফিসার বাচ্চুর মাধ্যমে হিরন বাবুর অধিনে টাকি ক্যাম্পে আমরা প্রশিক্ষণ করি।
তারপর ক্যাপ্টেন সিপার অধিনে আমরা পেপে ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ করি। ক্যাপ্টেন গিলসার‘র পরিচালনায় প্রশিক্ষক সিংগেদার এর অধিনে আমরা প্রশিক্ষণ গ্রহন করি। হাবিলদার সিংগিদার, রাজপুত্র এর অধিনে আমরা অস্ত্রের প্রশিক্ষণ ও গ্রহন করি। গাইরোরাদের মাধ্যমে ডেনামাইন,মাইনসেট,স্প্যালাজার, গ্রেনেট চার্য, ডেটোনাটর মাইন, সহ এসেলার, এল এম জি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। সাওতাল জাতির মাধ্যমে বিভিন্ন অস্ত্রের প্রশিক্ষণ করি।
ভারতে সিওর (ল্যাঃ কর্নেল)‘র মাধ্যমে আমরা যুদ্ধের বিভিন্ন কৌশল প্রশিক্ষণ করছি। সে বলতো দেশে যেয়ে তোমরা এই সব অস্ত্রের ব্যবহার করতে পারবে ? আমরা বলতাম পারবো। আমার ভারতের ব্যাচ নং ৭৪০৭,নিজস্ব পরিচিতি ব্যাচ নং ১৩, লেঃ কর্নেল আমাদের বাগুনদে পাঠালো মেজর জলিল, মেজর জিয়া, শেখ নাসের সাহেব, খায়ের মিয়া, ডাঃ মুনসুর এম.পি, বুরান সাহেব, নিরঞ্জন বাবু এই সকল লোক নৌবাহিনীর ল্যাঃ সেকেলউদ্দিন গাজী কমান্ডার হিসাবে আমাদের সাথে অস্ত্র দিয়ে বাগদা বর্ডার দিয়ে আমাদের বাংলাদেশে পাঠান আবু তালেব শরীফ দক্ষিনে মোংলা পোর্ট হয়ে পার্টি নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। তখন আমরা সফর সঙ্গী হিসাবে ৩০০ জন ছিলাম।
সি এম বি পার হয়ে শতবছর পুরানো ঝিনাইদহ কালিগঞ্জের বটগাছের নিচে আমরা অবস্থান করি। পানিঘাটা, কাশিয়ানি, ইতনে, বর্দে, তেরখাদা, চরকুলিয়া, হাড়িদাহ, মোল্লারকুল মেহেরুনের বাড়ির কাছে, মোল্লাহাট ব্রিজের পূর্ব পাশে, সোনাপুরা, রামচন্দ্রপুর এই জায়গার উপর দিয়ে এসে আমরা সিরামকান্দি, লক্ষণ, লুৎফার এদের বাড়ী অবস্থান করি। এরপর সিরামকান্দির কালাম সি.অই.ডি হিসাবে আমাদের কে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যায়। শেখ মুজিবুর রহমানে‘র বাড়ি ভাংচুর করা দেখে আমরা ১০০ জন মুক্তিযোদ্ধাগন যেয়ে পাটগাতির পিচকমিটির কমান্ডার নুরু মিয়ার বাড়ি ভাংচুর করি। চাঁনপুর আমরা রাজাকারের সাথে ফাইট করি।
আজগড়া আদম চেয়ারম্যানের বাড়িতে দখলরত পাকিস্তানি ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদরসহ অন্যান্যরা সেখানে অবস্থান করছিল এ সংবাদ পেয়ে আমরা তাদের এটাক করি। পালেরহাট, কাকডাঙ্গার চরে, চিপ্রেলতলা, বেলফুলের স্কুলের পাশে ফাইটের সময় আমার বামপায়ে গোড়ালির উপর গুলি লাগে, এছাড়াও আমার সাথী জহর মীর তার বাম কাঁধে গুলি লাগে যা তিনি এখনও শরীরে বহন করে চলছেন। গোপন সূত্রে সংবাদ পেয়ে আমরা স্যানের বাজারের নিকটবর্তী পাকিস্তান সরকারের সময়ে মুসলিম-লীগ থেকে তখনকার সময়ে পাকিস্তান সরকারের শিক্ষামন্ত্রী হিসাবে দায়িত্বরত আমজেদ এর বাড়িতে পাকিস্তানী সৈনিক ও তাদের দোসরদের যুদ্ধকালীন ক্যাম্প ছিল।
আমরা তৎক্ষনাত সেখানে যেয়ে পাকসেনাদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে তাদের ক্যাম্প দখল করি এবং সেখান থেকে বিএ খানের ঘাট থেকে লঞ্চ এর মাধ্যমে নদী পার হয়ে এম এ সবুর খানের বাগমারা বাড়ী দখল করে আমরা ক্যাম্প করি প্রায় ১০০০ জনের অধিক মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে অবস্থান করি। ৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত আমরা সেখানে অবস্থান করি। বঙ্গবন্ধু দেশে আসার পর যুদ্ধকালীন সময়ে ব্যবহৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র জমা করার আহŸান জানালে আমরা সাথে সাথে ফুলতলা দায়িত্বরত অফিসারের নিকট অস্ত্র জমা করি। ভারতের বিহার চাকুলিয়া ৭ম উইং এ প্রশিক্ষণ শেষ পর্যায়ে হেলিকাপ্টার যোগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরাগান্ধী, ডাঃ মুনসুর আহম্মদ, তাজউদ্দিন আহম্মেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও কর্নেল ওসমানি পরিদর্শনে এসেছিলেন। অররা নিয়াজীকে হেলিকপ্টারে করে ভারত নিয়ে গেলেন ১৬ই ডিসেম্বর। ৭১ এ পরাজিত শাসকগোষ্টি পাঞ্জাবী, পাঠান, বেলুচি, সিন্ধুর সৈনিকেরা বাংলাদেশের ঘরবাড়ীসহ স্কুল,কলেজ, সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট ব্রীজ কালভার্ট সমস্ত ভাংচুর, আগুনে পুড়িয়ে শেষ করে দিয়ে যায়।
এছাড়া নিরীহ মা,বোনদের ব্যানেট দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করে। মোল্লাহাটের দারিয়ালার বড় আবুল, মুজিবার শিকদার, তেরখাদার ফহম ও আব্দুল্লাহ ছাকাতি সহ ৪ জনে মিলে দারিয়ালা বাজার থেকে সুলতান মুন্সীর ব্যক্তিগত দর্জির ঘরকে অফিস হিসাবে ব্যবহার করে মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুট করিয়া প্রশিক্ষণের জন্য ভারত পাঠাতেন। বড় কাচনার নাসির দারোগা ও মিলু শেখ রিক্রুটকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের বাগুন্দে ক্যাম্পে নিয়ে যেতো এবং প্রশিক্ষণ শেষে আবার তারা মুক্তিযোদ্ধাদের দেশে নিয়ে আসতো।
এছাড়াও এফ এম মহিউদ্দিন ওরপে ছোট আবুল মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে থেকে কোয়ার্টার মাষ্টার হিসাবে খাবারের দায়িত্বে নিয়োজীত ছিলেন। প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা প্রয়োজনে দেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে সরাসরি পাকিস্তানি সৈনিক ও তাদের এদেশিও দোসরদের বিরুদ্ধে স্বসস্ত্র যুদ্ধ করতেন। যুদ্ধকালীন সময়ে ছোটকাচনা নিবাসী জহর মিরের কাছে রাশিয়ান এল এম জি থাকতো আর আমার কাছে চায়না এল এম জি যাহার ধারন ক্ষমতা ছিল এক ম্যাগজিনে ১০০ রাউন্ড গুলি। আমার মাধ্যমে দেশের ভিতরে বিভিন্ন সম্মুখ যুদ্ধে প্রায় ২০০০(দুই হাজারের) মত পাকিস্তানী সৈনিক ও তাদের দোসরা মারা গেছে। এ যুদ্ধ গুলো হয় নড়াইল জেলার কালিয়া থানার ভিতরে বড়দে, গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী, ভাটেপাড়া, মোল্লাহাটের চরকুলিয়া ওলিমুদ্ধির ব্রিজের নিকট ও হাড়িদাহ যুদ্ধে ক্যাপ্টেন সেলিম সহ অসংখ্য পাকিস্তানি সৈনিক মারা যায়।
গাঘর আগত পাকিস্তানির নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন এর কাছ থেকে এই এল এম জি টা নেওয়া হয়েছিল এবং সাথে ১০টি ম্যাগজিন ছিল, যার প্রত্যেকটিতে ১০০ রাউন্ড গুলি ছিল। আমি ও আমার সহযোদ্ধা জহর মীর এখনও সে ট্রেনিং ভুলি নাই। ঐ সকল অস্ত্র আমাদের এখনো দেওয়া হলে, আমরা তা চালাতে পারবো। বর্তমান শেখ হাসিনা সরকার আমাদের পরীক্ষা করতে চাইলে, পরীক্ষা দিতে আমরা প্রস্তুত আছি এবং আমাদের সাথে সাক্ষাত করতে চাইলে করতে পারেন। তথ্যপ্রদানকারীঃ বীরমুক্তিযোদ্ধা মোঃ হাসান মোল্লা
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত