মামলার অভিযোগকারী থেকে যে ভাবে হলেন মামলার আসামী


# নিজের পাতা ফাঁদেই আটকা পড়লেন সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ
# মামলার অভিযোগকারী থেকে হয়ে গেলেন মামলার আসামী
# তদন্তের কমিটিতে নিজেই হন তদন্ত কমিটির সভাপতি
# ২ কোটি ৬১ লাখ টাকার মধ্যে ডা. নিয়াজ মোহাম্মদের যোগসাজশে আত্মসাৎ করা হয় ১ কোটি ৮২ লাখ টাকা।
# এধরনের জামিন দেওয়া মানে দুর্নীতি কে প্রশ্রয় ও সুযোগ করে দেওয়া
# আইনের নামে সাধারণ মানুষের আইওয়াশ করা হয়েছে
করোনাকালীন সময়ে টানা ১৩ মাস ধরে করোনা পরীক্ষার ২ কোটি ৬১ লাখ টাকা আত্মসাৎ এর পর যখন বিষয় টি জানাজানি হয়ে যায় তখন নিজে বাচতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে খুলনার তৎকালীন সিভিল সার্জন ও গোপালগঞ্জ থেকে সদ্য ওএসডি হওয়া সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ। পাচ সদস্যের ওই তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ নিজেই। তখন দায়সারা তদন্ত করে শুধু মাত্র মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ( ল্যাব) উপর দায় চাপিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়।নিজের তদন্ত করা দায়সারা তদন্ত প্রতিবেদনর উপর ভিত্তি করে ল্যাব টেকনিশিয়ানের বিরুদ্ধে থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন খুলনার তৎকালীন সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ। এরপর সেই তদন্ত প্রতিবেদন ও জিডির কপি নিজেই জমা দেন খুলনার দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বিভাগীয় কার্যালয়ে। পরবর্তী তে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বিষয়টি আমলে নিয়ে ২০২১ সালের নভেম্বরে শুধুমাত্র ল্যাব টেকনিশিয়ানের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করেন। এরপর দুদকের দীর্ঘ তদন্তে বেরিয়ে আসে আসল রহস্য। নিজের পাতা ফাঁদেই আটকা পড়েন সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ। হয়ে যান মামলার অভিযোগকারী থেকে মামলার আসামী। রুপ নেয় রক্ষক থেকে ভক্ষকে।
চলতি বছরের ২৭ জুলাই গোপালগঞ্জ থেকে সদ্য ওএসডি হওয়া সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ ও খুলনার সাবেক সিভিল সার্জন সুজাত আহমেদ সহ ৬ জনের বিরুদ্ধে করোনা পরীক্ষার ফির ২ কোটি ৬১ লাখ টাকা আত্মসাতের মামলায় আদালতে চার্জশিট দাখিল করে দুর্নীতি দমন কমিশন ( দুদক)।
অভিযোগ পত্রে বলা হয়, ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত করোনা পরীক্ষার ফি ২ কোটি ৬১ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয় । এরমধ্যে ২০২০ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তৎকালীন সিভিল সার্জন সুজাত আহমেদের যোগসাজশে ৭৯ লাখ ও ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ এর যোগসাজশে ১ কোটি ৮২ টাকা সহ মোট ২ কোটি ৬১ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়।
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয় ,তৎকালীন সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ ও ডা. সুজাত আহমেদ সহ পরস্পর যোগসাজশে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট খুলনা জেনারেল হাসপাতালের সরকারি রসিদ বইয়ের বাইরে ডুপ্লিকেট রসিদ বই ব্যবহার করে বিদেশগামী যাত্রী ও সাধারণ কোভিড-১৯ রোগীদের নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষার জন্য খুলনা মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের ল্যাবে প্রেরণ করা হতো। তবে ল্যাবে যে পরিমাণ নমুনা পাঠানো হতো তার থেকে রোগীর সংখ্যা কম দেখিয়ে টেস্টের ফির টাকা আত্মসাৎ করা হয়। ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত মোট ফি আদায় করা হয়েছিল ৪ কোটি ২৯ লাখ ৯১ হাজার ১০০ টাকা। তবে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়েছিল ১ কোটি ৬৮ লাখ ৪৬ হাজার ৭০০ টাকা। বাকি ২ কোটি ৬১ লাখ ৪৪ হাজার ৪০০ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
এ মামলার বাকী আসামীরা হলেন, ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট খুলনা জেনারেল হাসপাতালের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব) প্রকাশ কুমার দাস, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব) মো. রওশন আলী, ক্যাশিয়ার তপতী সরকার, আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. এস এম মুরাদ হোসেন।
রবিবার ১০ সেপ্টেম্বর কথা হয় এ মামলার বাদী ও তদন্তকারী কর্মকর্তা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) খুলনার বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ পরিচালক খন্দকার কামরুজ্জামান এর সাথে। দীর্ঘ আলাপে জানা যায় কি ভাবে এ মামলার অভিযোগকারী থেকে মামলার আসামী হলেন সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ।
দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত প্রায় ১৩ মাস ধরে আসামীদের পরস্পরের যোগসাজশে এই এই টাকা আত্মসাৎ করা হয়। ২০২০ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ মাস তৎকালীন সিভিল সার্জন সুজাত আহমদের সহ বাকিরা প্রায় ৮২ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে। পরে সুজাত আহমদের বদলি হলে তার জায়গায় আসে তৎকালীন সিভিল সার্জন ও মামলার অপর প্রধান আসমী ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ।
ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ সিভিল সার্জন হয়ে যোগদানের পরও চলতে থাকে করোনা পরীক্ষার ফি আত্মসাৎ। তিনি জেনেশুনে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করে উক্ত আত্মসাতে সহায়তা শুরু করেন। বিদেশগামী যাত্রীদের কোভিড-১৯ এর নমুনা পরীক্ষার জন্য খুলনা মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজী বিভাগে নমুনা প্রেরণের ফরওয়ার্ডিংয়ে নমুনার সংখ্যা লেখার জায়গা ফাঁকা রেখে তারিখবিহীন স্বাক্ষর করে অন্যান্য আসামিদেরকে উক্ত ফাঁকা জায়গায় ইচ্ছামতো নমুনার সংখ্যা ও তারিখ বসিয়ে ডুপ্লিকেট রশিদ বইয়ের মাধ্যমে সংগৃহীত নমুনা খুলনা মেডিকেল কলেজ খুমেক’র আরটি পিসিআর ল্যাবে প্রেরণের সুযোগ করে দিয়েছেন। পরবর্তীতে রোগীর সংখ্যা কম দেখিয়ে সেই অনুযায়ী ইউজার ফির টাকা সরকারি কোষাগারে জমা প্রদান করে। অর্থাৎ প্রকৃত আদায়কৃত ইউজার ফির টাকা জমা প্রদান না করে এবং প্রেরিত নমুনার ফলাফল তিনি প্রতিদিন ই-মেইলের মাধ্যমে প্রাপ্ত হয়ে নমুনার সংখ্যা ও ফলাফলের সংখ্যা
রেকর্ডভিত্তিকভাবে অবগত হয়ে অন্যান্য আসামিদের সাথে যোগসাজশে ইউজার ফির আদায়কৃত টাকা প্রতিদিন সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে দীর্ঘদিন পরপর (৩-৪ মাস) চালানে স্বাক্ষরপূর্বক জমা দিয়ে সরকারি টাকা আত্মসাত করেছেন।
এরপর উক্ত অপরাধের ঘটনা জানাজানি হওয়ায় তিনি তড়িঘড়ি করে তার অধীনস্থ হাসপাতালের ডাক্তারদের সমন্বয়ে ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে নিজে উক্ত কমিটির সভাপতি হয়ে প্রভাব বিস্তার করে তার ইচ্ছামতো তদন্ত সম্পন্ন করে এককভাবে ল্যাব ইনচার্জ প্রকাশ কুমার দাসের ঘাড়ে অপরাধের দায় চাপিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুতপূর্বক নিজে অভিযোগকারী হিসেবে দুর্নীতি দমন কমিশনের লিখিত খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ে একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।
এরপর দীর্ঘ তদন্তে বেরিয়ে আসে তার আসল কর্মকাণ্ড। তিনি বিদেশ গমনেচ্ছু কোভিড-১৯ রোগীদের গৃহীত নমুনার প্রকৃত সংখ্যা আড়াল করার অসদুদ্দেশ্যে খুলনা মেডিকেল কলেজে প্রেরিত নমুনার ফরওয়ার্ডিংয়ের অনুলিপি সংরক্ষণ না করে বা সরিয়ে ফেলে অন্যান্য আসামিদের সাথে যোগসাজশে কোভিড-১৯ রোগীদের ইউজার ফির সরকারি মোট আত্মসাতকৃত দু’কোটি ৬১ লাখ ৪৪ হাজার টাকার মধ্যে তার কর্মকালীন সময়ে এক কোটি ৮২ লাখ ৪৭ হাজার টাকা আত্মসাত করে দন্ডবিধির 809/20/867 / 8৬৮/৪৭১/১০৯ ধারা সহ ১৯৪৭ সনের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন বলেও দুদকের তদন্তে উল্লেখ করা হয়েছে ।
এদিকে, আদালতে চার্জশিট দাখিলের পর অভিযুক্ত গোপালগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ উচ্চ আদালত থেকে দুই সপ্তাহের জামিন নেয় তিনি। এরপর গত ৭ সেপ্টেম্বর খুলনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের নিম্ন আদালত উপস্থিত হয়ে স্থায়ী জামিনের আবেদন করেন তিনি। এদিন জামিন পেতে ১ ঘন্টা ২০ মিনিট আদালতের কাঠগড়ায় দাড়িয়ে ছিলেন গোপালগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ। পরে দু পক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক ও দীর্ঘ শুনানি শেষে আদালত ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ এর জামিন মঞ্জুর করেন। গত বৃহস্পতিবার ৬ সেপ্টেম্বর খুলনা মহানগর জেলা ও দায়রা জজ আদালত বিচারক শরীফ হোসেন হায়দার সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মাদ এর জামিন মঞ্জুর করেন।
ডা. নিয়াজ মোহাম্মদের জামিনের বিষয় টি নিশ্চিত করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী এড. খন্দকার মুজিবর রহমান।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, জামিন আদেশের কপি তুলে বিষয়টি দুদকের প্রধান কার্যালয়ে জানানো হয়েছে পাশাপাশি উচ্চ আদালতে আপীল করা হবে। আমার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে এমন জামিন দেখি নাই। যদিও আদালত চাইলে তাকে জামিন দিতে পারে। কিন্তু এ ধরনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের জামিন দেয়ার মানে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়া বলে আমি মনে করি ।
এদিকে করোনা পরীক্ষার ২ কোটি ৬১ লাখ টাকা আত্মসাতের ঘটনায় গোপালগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ কে ওএসডি করা হয়েছে। তাকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মহাখালীতে সংযুক্ত করা হয়েছে। তার যায়গায় স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মো. জিল্লুর রহমান। বৃহস্পতিবার ৭ সেপ্টেম্বর বিকেলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. আলমগীর কবীর স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য জানানো হয়।
গভমেন্ট সার্ভিস রুলস অনুযায়ী যেখানে ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ কে সাময়িক বহিষ্কার না করে শুধুমাত্র ওএসডি করায় সাধারণ মানুষ কে আইনের নামে আইওয়াশ করা হয়েছে বলে মনে করছেন দুদকের ওই আইনজীবী খন্দকার মুজিবর রহমান।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, গভমেন্ট সার্ভিস রুলস অনুযায়ী আমরা যেটা দেখি সরকারি কর্মকর্তা অথবা কর্মচারী যদি কোন ফৌজদারি অপরাধের সাথে সংগঠিত হয়ে চার্জশিটভুক্ত আসামী হন তিনি চাকরি থেকে সাময়িক বহিষ্কার হবেন। পরবর্তী মামলার রায়ে যদি তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন তাহলে তিনি চাকরিতে পুনর্বহাল হবেন। আর যদি তিনি দোষী প্রমাণিত হন তাহলে তিনি চাকরি থেকে স্থায়ী বহিস্কার হবেন। কিন্তু এখানে ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ কে ওএসডি করা হয়েছে। এটা আসলে আইন না সাধারণ মানুষ কে আইওয়াশ করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ।
ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ কে সাময়িক বহিষ্কার না করে ওএসডি কেন করা হলো জানতে চাইলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. আলমগীর কবীর বলেন, আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে পারবো না। আমি আমাদের সিনিয়র সচিব স্যারের নির্দেশে তা কে ওএসডি করা হয়েছে। আমি নির্দেশিত প্রজ্ঞাপনে শুধুমাত্র সাক্ষর করেছি। এ বিষয়ে বলতে পারবেন আমাদের সিনিয়র সচিব স্যার ডা. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার।
এ বিষয়ে জানতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব ডা. আনোয়ার হোসেন হাওলাদারের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি। মোবাইল ফোনে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও কোন সাড়া মেলেনি।