বিজয়ের আনন্দে সারা দেশ যখন আত্মহারা, সে সময়ও গোপালগঞ্জের ভাটিয়াপাড়ায় পাক হানাদার বাহিনী যুদ্ধ করে যাচ্ছিলো।
১৯ ডিসেম্বর বিজয়ের তিন দিন পর মিত্র ও মুক্তি বাহিনীর আক্রমনে পাক হানাদারদের দখলে থাকা, কাশিয়ানী উপজেলার ভাটিয়াপাড়া ওয়্যারলেস স্টেশন ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি সেনাদের পতন ঘটে, এবং আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। মুক্ত হয় ভাটিয়াপাড়া।
রনাঙ্গনে বীর মুক্তিযোদ্ধ নুর মুহম্মদ কাজী জানান-
কাশিয়ানীর ভাটিয়াপাড়া ওয়ারলেস সেন্টার ১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল মাসে এক প্লাটুন সশস্ত্র পাকসেনা রেলযোগে এসে দখল করে অবস্থান নেয়।
রাজাকারদের সহায়তায় ১৩ এপ্রিল পিংগলিয়া গ্রামের সন্তান আওয়ামী লীগ নেতা কে এম আমজাদ হোসেন, বাগঝাপা গ্রামের মোক্তার শেখ, মাজড়ার হাবিবুর রহমান বাবু মিয়ার বাড়িসহ শতাধিক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর ঘরবাড়ি অগ্নিসংযোগ করে।
মাজড়া গ্রামের জহির উদ্দিন মৌলভীর ছেলে বেলায়েত, যদু মিয়ার স্ত্রী ও বাগঝাপা গ্রামের আক্কাস শেখ কে গুলি করে হত্যা করে।
১৪ এপ্রিল পোনা গ্রামের নুর মুহম্মদ কাজী স্ত্রী কুটি বিবি,সামচু কাজী,খালেক শেখ সহ ১১ জনকে গুলি করে হত্যা করে এবং ৬টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।
মে মাসের শেষ দিকে এলাকায় মুক্তি যোদ্ধা দল গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে - খালিদ ফিরোজ ও আক্কাস হোসেন এর নেতৃত্বে।
ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা ৩১ জুলাই হতে আগষ্ট মাসে এলাকায় এসে যুদ্ধ শুরু করে।
কাশিয়ানীতে মুক্তিযুদ্ধের কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল ক্যাম্প স্থাপন করা হয় ওড়াকান্দি মিড হাইস্কুলে।
ক্যাম্পের দ্বায়িত্বে ছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নূরুল কাদির জুন্নুর ছোট ভাই ইসমত কাদির গামা ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন।
এছাড়াও রামদিয়া এসকে কলেজ, সাজাইল গোপী মহন হাইস্কুল, রাতইল স্কুল, জয়নগর স্কুলসহ অনেক স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে মুক্তিযোদ্ধারা।
সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেওয়া বীরমুক্তি যোদ্ধা মোঃ কবির উদ্দিন খান বলেন-
উপজেলার ফুকরা লঞ্চঘাট এলাকায় ৩১ অক্টোবর মাসের রবিবার খুলনা থেকে নদী পথে তিনটি লঞ্চ ভর্তি পাক সেনারা এসে মুক্তি বাহিনীর সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ করে ।
এতে পাকবাহিনীর অর্ধশতাধিক সেনা নিহত হয় এবং আবুবকর, রবিউল সহ আঠারো জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
ভাটিয়াপাড়া রেল স্টেশনটি নদী বন্দর গোপালগঞ্জ - ফরিদপুর ও নড়াইল জেলার সীমান্তে অবস্থিত। ভাটিয়াপাড়া মিনি ক্যান্টনমেন্ট দখল নিয়ে পাক হানাদার ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে লড়াই হয় কয়েক দফা।
পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর একটি গ্রুপ দীর্ঘ নয়মাস ব্যাপী এখানে অবস্থান করে এলাকায় নিরীহ মুক্তিকামী মানুষের উপর নির্যাতন, নিপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞ চালায়। অনেক মুক্তিকামী মানুষকে পাকবাহিনী হত্যা করে মধুমতি নদীতে ফেলে দিত।
৬ নভেম্বর পাক বাহিনীর ক্যাম্পটি দখল নিয়ে দুটি মারাত্মক যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধা বাবুল, ইসমত কাদির গামার নেতৃত্বে টানা ১৫ ঘণ্টা যুদ্ধ হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের পরাজিত করতে পাকবাহিনী আকাশ পথে গুলি ও বোমা বর্ষণ করে।
কিন্তু সেদিন জীবন বাজি রেখে অসীম সাহসী মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেনি। এ যুদ্ধ যথেষ্ট ঘায়েল হয় পাকবাহিনী।
১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের দিনে এই ওয়্যারলেস ক্যাম্প দখল নিয়ে দ্বিতীয় দফায় টানা ৩ দিন যুদ্ধ হয়।
ভাটিয়াপাড়া ক্যাম্পে সরাসরি যুদ্ধ অংশ নেওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধ শেখ সোরাফ হোসেন প্রতিবেদককে জানান-
১৯ ডিসেম্বর খুব ভোরে নড়াইল জেলার দিক থেকে ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর মঞ্জুর, নড়াইল জোনের মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার ক্যাপ্টেন হুদা, লে. কর্ণেল জোয়ান, কামাল সিদ্দিকী, গোপালগঞ্জ ও ফরিদপুরের দিক থেকে ক্যাপ্টেন ইসমত কাদির গামা ও বাবুলের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডারগণ সম্মিলিতভাবে ভাটিয়াপাড়ার মিনি ক্যান্টনমেন্টে আক্রমন চালায়।
মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাত্মক হামলা ও বীরোচিত সাহসী যুদ্ধে অবশেষে ১৯ ডিসেম্বর সকাল ১০টার দিকে মুক্তি বাহিনীর কমান্ডার আজিজুর রহমান খেপু সহ মিত্র বাহিনীর যৌথ কমান্ডারের কাছে ৬৫ জন পাক সেনা আত্মসর্মপণ করে। এ যুদ্ধে ৬ জন পাক সেনা নিহত হয়। অপরদিকে, মুক্তিযোদ্ধা এ কিউ এম জয়নুল আবেদীন,মজিবর রহমান,মহিউল হক মিন্টু, মশিউর রহমান সিকদার, অনিল কুমার বিশ্বাস,মজিবর রহমান,মোহাম্মদ হান্নান শেখ সহ নিহত ও আহত হয় কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। এরপর ভাটিয়াপাড়ার ওয়্যারলেস স্টেশনের মিনি ক্যান্টনমেন্টে উড়ানো হয় লাল-সবুজের পতাকা