নড়াইলে বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী জাতীয় ফুল শাপলা

নড়াইলে বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী জাতীয় ফুল শাপলা। নড়াইলে এক সময়ের ভালোবাসা আর মনমুগ্ধকর ঘ্রাণ যেন ছিল শাপলা ফুলে মাঝে। তেমনি ছিল মানুষের মুখে মুখে একটা ফুলের নাম শাপলা, মানে জাতীয় ফুল শাপলার কথা বলছি। এক সময় এই শাপলা ফুল ছিল সবার মাঝে ভালোবাসার রং চুলের খোঁপায় গেঁথে থাকত আমাদের জাতীয় ফুল শাপলা। কিন্তু হারাতে বসেছে সেই গ্রামের প্রাচীন ঐতিহ্য। ভোরের উষ্ণতা কিচিরমিচির পাখির ডাক এক সময়ের সেই প্রকৃতির মাঝে শীতের কুয়াশা কাটতে না কাটতেই সূর্যের ঝলকানিতে শাপলা ফুলের হাসি অনুভব করতেন মানুষ।

কিন্তু প্রাচীনের সেই মানুষের প্রকৃতির ভালোবাসা আর শাপলা ফুল আজ বিলুপ্তির পথে, হারাতে বসেছি আমরা জাতীয় ফুল শাপলা। বাংলাদেশের জাতীয় ফুল শাপলা তেমন আর চোখে পড়ে না। এক সময় গ্রামীণ জনপদের পুকুর-দীঘি, ডোবা-বিলে শাপলা ফুল মানুষের মনকে মুগ্ধ করত। প্রকৃতি প্রেমীদের কাছে এ ফুল ছিল সাহিত্যের ছন্দমিলানোর উপকরণ। ফুলের সৌন্দর্যে পুকুর-দীঘি দেখতে আকর্ষণীয় ও মনোমুগ্ধকর। শাপলা ফুল দুই প্রকারের। সাদা শাপলা ও রক্ত শাপলা। রক্ত শাপলা সবচেয়ে আকর্ষণীয়। এ ফুল প্রকৃতির শোভাবর্ধণের উপকরণও বটে। তাছাড়া ফুলের ডাঁটাগুলো সুস্বাদু তরকারি। ডাল দিয়ে রান্না করলে শাপলা ফুলের ডাঁটা খেতে খুব মজা হয়। শাপলা ফুল ও ডাঁটা এক প্রকার ঔষধী গাছ। মস্তিক ও শরীর ঠাণ্ডা রাখার জন্য শাপলার ডাঁটা লবণ দিয়ে খেলে খুব উপকার পাওয়া যায়। এ ফুল ও ডাঁটা কবিরাজি ওষুধের অন্যতম উপকরণ। উপকরণের অভাবে বর্তমানে কবিরাজি ওষুধের ব্যবহার অনেক কমে গেছে। গ্রামগঞ্জে কবিরাজ ও কবিরাজি ওষুধের দোকান তেমন আর চোখে পড়ে না।

প্রাচীনকালের এক সময় নড়াইলের বিত্তশালী ও জমিদার পরিবারগুলো নিজেদের ব্যবহার ও এলাকার মানুষের জলাচারের জন্য পুকুর-দীঘি খনন করত। বিত্তশালী জমিদার পরিবারের মহিলাদের ব্যবহারের জন্য বাড়ির ভেতরের আঙিনায় পুকুর-দীঘি খননের রেওয়াজ ছিল। ভেতরের পুকুরের শোভাবর্ধণের জন্য শাপলা ফুলের গাছ লাগানোর কথাও জনশ্রুতি রয়েছে। আবার যে পুকুরে শাপলা ফুলের আবাদ হয় সেখানে বিভিন্ন ধরনের দেব দেবতা ও জ্বীনপরীর আশ্রয় থাকার কথা ও লোকমুখে প্রচারিত রয়েছে। জন সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের খাদ্য তালিকায় প্রোটিনের চাহিদা মিটাতে পুকুর দীঘিগুলো জন্য প্রয়োজনে আবাদ হতে থাকে। এসব পুকুর-দীঘি মাছ চাষের জন্য আবাদ করতে গিয়ে সেচ দিয়ে শাপলা ফুলের গাছের মূল উৎপাটন করে ফেলা হয়েছে।

তাছাড়া অংশীদারিত্বের বিবাদের কারণে অনেক পুকুর দীঘি ময়লা-আবর্জনায় ভরে গিয়ে ব্যবহার অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। পরিষ্কার পুকুর-দীঘিতে সাধারণত শাপলা ফুলের আবাদ হয়ে থাকে। আবর্জনায় ভরা পুকুর-দীঘিতে এ জাতীয় ফুলের আবাদ হয় না। আবার অনেক জায়গায় বসতি স্থাপন করতে গিয়ে প্রতিযোগিতামূলকভাবে গৃহস্থ বাড়ির ঐতিহ্য পুকুর-দীঘি ভরাট করে ফেলা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেও অনেক প্রকারের ঔষধী গাছের আবাদ কমে যাচ্ছে। এতে শাপলা ফুলের আবাদও কমতে শুরু করেছে।

যাদের পুকুর-দীঘিতে শাপলা ফুল ফোটে তাদের অনেকেই ভাগ্যবান হিসেবে আখ্যায়িত করেন। পুকুর-দীঘিতে মাছ চাষ করতে গিয়ে প্রতি বছর পুকুর-দীঘির পানি সেচে শুকিয়ে ফেলা হয়। এতে রোদের তাপে তলা শুকিয়ে শাপলা ফুলের বীজ নষ্ট হয়ে যায়। ফলে এ ফুল এখন আর গ্রামে দেখা যায় না। শাপলাকে সরকারিভাবে জাতীয় ফুল হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠ্যবইয়ে শাপলা ফুলের ব্যাপারে নানাভাবে বর্ণনা দেয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবইয়ে শাপলা ফুল নিয়ে পড়াশোনা করে। এমনকি পরীক্ষাও দিয়ে থাকে। তারা বইয়ের ছবিতে শাপলা ফুলের আকার আকৃতি দেখে তাকে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এ ফুল তারা এখন তেমন দেখতে পায় না। জাতীয় এ ফুলকে শিক্ষার্থীদের প্রদর্শন করে দেখানোর জন্য গ্রামগঞ্জের কিছু কিছু পুকুর-দীঘিতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এ ফুলের চাষাবাদ করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন অনেকেই। বিশেষ করে সরকারি খাস জায়গায় প্রতিষ্ঠিত পুকুর-দীঘি কিংবা পতিত জলাশয়ে মনোমুগ্ধকর এ ফুলের চাষাবাদ করা এখন সময়ের দাবি।



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked as *