নড়াইলে প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক ডা. নীহাররঞ্জন গুপ্তের পৈত্রিক বাড়ি এখন মাদকসেবীদের আঁখড়া খানা
নড়াইলে প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক ডা. নীহাররঞ্জন গুপ্তের পৈত্রিক বাড়ি এখন মাদকসেবীদের আঁখড়া খানা। প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক ডা. নীহাররঞ্জন গুপ্তের পৈত্রিক ভিটে নামেই প্রত্নতত্ত¡ বিভাগের সম্পত্তি। অবহেলা আর অনাদরে এই বরেণ্য ঔপন্যাসিকের জন্মভিটার শেষ চিহ্নটুকু হারিয়ে যেতে বসেছে। সরকারি বা বেসরকারি কোনো উদ্যোগেই তার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয় না। ফলে বর্তমান প্রজন্ম ভুলতে বসেছে গুণী এই ঔপন্যাসিকের কথা।
১৯১১ সালের ৬ জুন বাবা সত্যরঞ্জন গুপ্তের কর্মস্থল কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন নীহার। জন্মস্থান কলকাতা হলেও তার পৈত্রিক নিবাস নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার ইতনা গ্রামে। চরম অবহেলায় পড়ে রয়েছে প্রখ্যাত এই ঔপন্যাসিকের পৈত্রিক বাড়িটি। ডা. নীহাররঞ্জন গুপ্তের শেষ স্মৃতি চিহ্নটুকু পরিণত হয়েছে মাদকসেবীদের আঁখড়া হিসেবে। নীহাররঞ্জন গুপ্তর বাবা ছিলেন চাকরিজীবী। সেই সূত্রে তিনি বিভিন্ন স্থানে বেড়ে ওঠেন।
১৯৩০ সালে তিনি কোন্ননগর হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। পরে কৃষ্ণনগর কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে তিনি আইএসসি এবং কারমাইকেল মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সামরিক বাহিনীর ডাক্তার হিসেবে তিনি যুদ্ধে যোগ দেন। চাকরিজীবনের বাধ্যবাধকতা বিরক্তিকর মনে হওয়ায় তিনি চাকরি ছেড়ে কলকাতায় প্রাইভেট প্রাকটিস শুরু করেন।
অল্প সময়ের মধ্যেই চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে নগরীতে বিশেষ পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি। শৈশবেই সাহিত্যে হাতেখড়ি হয়েছিল নীহাররঞ্জন গুপ্তর। ১৬ বছর বয়সেই তার প্রথম উপন্যাস ‘রাজকুমারী’ প্রকাশিত হয়। তার লেখা উপন্যাসের সংখ্যা দুইশরও বেশি। প্রকাশিত উপন্যাসের মধ্যে ‘মঙ্গলসূত্র’, ‘উর্বশী সন্ধ্যা’, ‘উল্কা’, ‘বহ্নিশিখা’, ‘অজ্ঞাতবাস’, ‘অমৃত পাত্রখানি’, ‘ইস্কাবনের টেক্কা’, ‘অশান্ত ঘূর্ণি’, ‘মধুমতি থেকে ভাগীরথী’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘ঝড়’, ‘অপারেশন’, ‘ধূসর গোধূলী’, ‘উত্তর ফাল্গুনী’, ‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী’, ‘কালো ভ্রমর’, ‘ছিন্নপত্র’, ‘কালোহাত’, ‘ঘুম নেই’, ‘পদাবলী কীর্তন’, ‘লালু ভুলু’, ‘কলঙ্ককথা’, ‘হাসপাতাল’, ‘কাজললতা’ এবং ‘কিশোর সাহিত্য সমগ্র’ উল্যেখযোগ্য।
নীহাররঞ্জনের লেখা উপন্যাস অবলম্বনে ৪০টির বেশি চলচ্চিত্র হয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘উল্কা’, ‘বহ্নিশিখা’, ‘উত্তর ফাল্গুনী’, ‘লালুভুলু’, ‘হাসপাতাল’, ‘মেঘ কালো’, ‘রাতের রজনীগন্ধা’, ‘নিশিপদ্ম’, ‘নূপুর’, ‘ছিন্নপত্র’, ‘বাদশা’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘মায়ামৃগ’, ‘কাজললতা’, ‘কন্যাকুমারী’, ‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী’ প্রভৃতি। গোয়েন্দাকাহিনি ‘কিরীটি রায়’ তার অপূর্ব সৃষ্টি। তার লেখা কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আমাদের সিনেমাশিল্প সমৃদ্ধ হয়েছে। তার কালজয়ী উপন্যাস ‘লালুভুলু’ পাঁচটি ভাষায় চিত্রায়িত হয়েছে। ১৯৮৩ সালে উপন্যাসটি বাংলাদেশেও চিত্রায়িত হয় এবং দর্শককুলের প্রশংসা অর্জন করে। নীহাররঞ্জনের অনেক উপন্যাস থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয়েছে।
বিশেষ করে তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘উল্কা’ দীর্ঘদিন ধরে থিয়েটারের দর্শকদের মনোরঞ্জন করেছে। চিকিৎসক হিসেবে ব্যস্ত জীবনের মধ্যেও নীহাররঞ্জন রেখে গেছেন অসংখ্য সাহিত্যধর্মী সৃষ্টি, যা আপন সত্তায় ভাস্বর হয়ে রয়েছে। নীহাররঞ্জন গুপ্ত ১৯৮৬ সালের ২০ জানুয়ারি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। এই গুণী মানুষের পৈত্রিক শেষ স্মৃতি চিহ্ন এখনই রক্ষা না করলে অচিরেই কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। এই বিষয়ে ইতনা ইউপি চেয়ারম্যান নাজমুল হাসান টগর বলেন, ‘বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম পশ্চিমবঙ্গে জন্মগ্রহণ করেছেন। তাদের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী এদেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে।
অথচ নিহাররঞ্জনের মতো গুণী ঔপন্যাসিক আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসে সমুজ্জ্বল থাকলেও আমরা তাকে ভুলতে বসেছি। আমাদের প্রজন্ম জানেই না নীহাররঞ্জন কে ছিলেন। তাই অবিলম্বে তার পৈত্রিক বাড়িটি রক্ষা আর অন্ততপক্ষে তার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী যথাযোগ্য মর্যাদায় সরকারিভাবে পালন করা হোক।’ সম্প্রতি ডা. নীহাররঞ্জন গুপ্তের পৈত্রিক বাড়িটি জরাজীর্ণ বাড়িটিতে আশ্রিত হিসেবে এক বৃদ্ধা বসবাস করেন। তবে তিনি সরকারিভাবে ওই বাড়ির কেয়ারটেকার নন। প্রয়োজনীয় সংস্কারের অভাবে পুরনো ভবনটি ভেঙে যাচ্ছে। দ্রুত সংস্কারের পদক্ষেপ দেওয়া দরকার।’‘ঔপন্যাসিক ডাক্তার নীহার রঞ্জন গুপ্ত আমাদের গর্ব। বাড়িটি সংস্কার করা ছাড়াও প্রতি বছর তার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী সরকারিভাবে পালন করা উচিৎ।