ঝলকাঠীর ধানসিঁড়ি নদী আর নদী নয় মরা খাল হিসেবে রয়ে গেল


ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর উপজেলায় ধানসিঁড়ি নদীর ধারা বাঁচিয়ে রাখতে নদী খননের উদ্যোগ নেয় বর্তমান সরকার। তবে এই নদী খননের পর যেন খালে পরিণত হয়ে গেল । এতে ক্ষুব্ধ স্থানীয় বাসিন্দারা। তাঁদের অভিযোগ, গত দুই বছর আগেও যে নদীর প্রসস্ততা ৮০ ফুট রেখে খনন করা হয়েছে। সেই নদীর প্রশস্ততা এখন ৪৯ থেকে ৫৫ ফুট রেখে খনন কার্যক্রম চলছে যা একটি ছোট খালের সমান। নদীর তলদেশের মাটি উঠিয়ে পাড়ে রাখা হচ্ছে। এতে প্রশস্ততা আরও কমে যাচ্ছে। লোকদেখানো এ খনন কার্যক্রম বন্ধের দাবি করছেন স্থানীয়রা। সঠিক এস.এ নকশা অনুযায়ী খনন চান তাঁরা।
রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ একসময়ের প্রমত্তা ধানসিঁড়ি নদীর তীরে বারবার ফিরে আসার সংকল্প করেছিলেন। সেই ধানসিঁড়ি নদী আজ মরা খালে পরিণত হয়েছে। বারংবার এ নদী খননের নামে সরকারের কোটি কোটি টাকা লোপাট হচ্ছে। তবুও এ নদীতে ফিরে আসেনি আগের যৌবনের খরস্রোত ধারা। বর্তমানে নদীটি পুনঃখনন শুরু হয়েছে আর খননের নামে নদীটি বরং মেরে ফেলা হচ্ছে। নদীর তীরবর্তী একজন বাসিন্দা জাকির সিকদার বলেন, নদীর তলদেশ খনন করে মাটি দূরে ফেলার কথা। কিন্তু ঠিকাদাররা ইচ্ছে করেই পাড়ে ফেলছেন। যা পূনরায় বর্ষার মৌসুমে ও বছর ঘুরতে না ঘুরতেই নদীতে পড়বে। এতে আবার ভরাট হয়ে যাবে নদী।
এভাবে বছর বছর টেন্ডারে কোনো কাজ তো হচ্ছেই না, বরং কোটি কোটি সরকারি রাজস্ব টাকার লোপাট করছে একটি চক্র। বিগত ২০১০-১১ অর্থবছরেও প্রায় ৮৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ধানসিঁড়ি নদী খনন করা হয় যা পরে কোনো কাজে আসেনি। উল্লেখ্য আছে, ১৯১০ সালের সি.এস নকশা অনুযায়ী রাজাপুরের বাঘরী অংশে এ নদীর মোহনার প্রশস্ততা ছিল ৫৬৭ ফুট,তখন এই নদীতে বড় বড় জাহাজ চলত। এ নদীর মোহনায় তখন ছিল দক্ষিণ বঙ্গের সবচেয়ে বড় বন্দর। এখানে কলকাতা থেকে সরাসরি জাহাজ ভিড়ত। তবে দেশ ভাগের পর ১৯৫০ সালে পাকিস্তান সরকারের জরিপে এক নম্বর দাগে ধানসিঁড়ি নদীর মোহনায় প্রশস্ততা ছিল ২০০ ফুট।
১৯৫০ সালের নকশা বর্তমানে বলবৎ থাকলেও নদীর ২০০ ফুট প্রশস্ততার কোনরূপ অস্তিত্ব নেই। ঝালকাঠি জেলার পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, প্রধানমন্ত্রীর ডেল্টাপ্ল্যান অনুযায়ী ৬৪ জেলায় ছোট নদী, খাল খনন প্রকল্পের আওতায় ধানসিঁড়ি নদী খনন কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দুই বছর মেয়াদে দুই কিস্তিতে সাড়ে ৮ কিলোমিটার পুনঃখননের জন্য সর্বমোট ৪ কোটি ৪৯ লাখ ৩৮ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। বরাদ্দ অনুযায়ী ঝালকাঠি সদর উপজেলার গাবখান নদীর মোহনা থেকে দেড় কিলোমিটার বাদ দিয়ে রাজাপুর উপজেলার বাঘরী বাজারের জাঙ্গালিয়া নদীর মোহনা পর্যন্ত মোট সাড়ে ৮ কিলোমিটার খনন শুরু হয়। প্রকল্পের কার্যাদেশে নদীর ওপরের প্রস্থ ৮০ ফুট ও সমতল থেকে নদীর গভীরতা ১৫ ফুট এবং নদীর তলদেশের প্রস্ত ২০ ফুট করা হয়। কার্যাদেশে আরও উল্লেখ করা হয়, নদীর তলদেশ থেকে মাটি কেটে পাড় থেকে দূরে ফেলতে হবে। কিন্তু তখন খননকাজে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তদারকির অভাব ছিল।
এতে বর্ষা মৌসুমে খনন করা মাটি আবার নদীতে পড়ে তলদেশ ভরাট হয়ে যায়। ২০২১-২২ অর্থবছরে পুনরায় খননের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডে প্রস্তাব পাঠানো হয়। প্রস্তাব পাস হওয়ায় নতুন করে খননের জন্য ১ কোটি ৯২ লাখ টাকা বরাদ্দ আসে। এবার খননের কাজ পান পটুয়াখালী জেলার ঠিকাদার আবুল কালাম আজাদ। তিনি ১৫ দিন আগে ধানসিঁড়ি নদীর তলদেশ খননের কাজ শুরু করেন। সরেজমিনে দেখা যায়, সঠিকভাবে খননের অভাবে নদীতে প্রবাহ কমেছে। ফলে দুই পাড়ে কয়েক হাজার হেক্টর জমি অনাবাদি হয়ে পড়েছে। পানির অভাবে শুকনো মৌসুমে কৃষকেরা জমি চাষাবাদ করতে পারছেন না, তেমনি বর্ষা মৌসুমেও জমিতে আটকে পড়া পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় আমন ও ইরি ধান চাষে বিঘ্ন ঘটছে। বাঘরী গ্রামের ইউপি সদস্য ফোরোক সিকদার জানান, নদীটির উৎপত্তিস্থল বাঘরী মোহনা একদম ভরাট করে ফেলা হয়েছে। এতে নদীর পানি প্রবাহ কমে যাবে। দ্রুতই পলি জমাট হয়ে পুরো নদীটি মরে যাবে।
বর্তমানে যে খনন করা হচ্ছে, তা কোনো কাজেই আসবে না। মঠবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহ জালাল হাওলাদার বলেন, নদীটি খননের নামে মরা খালে পরিণত করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করছি, যাতে নদীটি যথাযথভাবে খনন করা হয়। ঠিকাদার আবুল কালাম আজাদ বলেন, নিয়ম মেনেই খনন করা হচ্ছে। কাজ চলছে, কোথাও কোনো ত্রুটি থাকলে সংশোধন করা হবে। যথাযথভাবে খননকাজ শেষ করা হবে। ঝালকাঠি পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী রাকিব হাসান বলেন, শুধু তলায় চার ফুট খনন করা হচ্ছে। ওপরের প্রশস্ততা আগের মতোই থাকবে। ঠিকাদার কিছু জায়গায় ভুল করেছিলেন। স্থানীয়দের অভিযোগের ভিত্তিতে সেগুলো ঠিক করতে বলা হয়েছে। মাটি কেটে নদীর পাড়ে রাখলেও কাজ শেষে তা অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হবে।