করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত্যু ঝুঁকি রয়েছে জেনেও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন করোনা রোগীদের বাঁচিয়ে তুলতে ফ্রন্টলাইন ফাইটার অর্থাৎ প্রথমসারির করোনা যোদ্ধা হিসেবে নিত্যদিন যুদ্ধ করে চলেছেন অসংখ্য চিকিৎসক। সাধারণ ওয়ার্ড থেকে শুরু করে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন রোগীদের পরম মমতায় সুচিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তুলছেন তারা।
করোনা সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে চিকিৎসকরা ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) পরিধান করে ডিউটি করলেও রোগীদের সংস্পর্শে এসে অনেকেই এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং আক্রান্তদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ইতিমধ্যেই মারাও গেছেন। আরও কয়েকজন কোনো উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন। চিকিৎসকদের মধ্যে সবচাইতে ঝুঁকিতে রয়েছেন বয়স্করা।
ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি অ্যান্ড রাইটসের (এফডিএসআর) তথ্যানুসারে গত ১৫ এপ্রিল দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রথম চিকিৎসকের মৃত্যু হয়। ৪ জুন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে সর্বমোট ১৮ চিকিৎসকের মৃত্যু হয়। এছাড়া করোনা উপসর্গ নিয়ে আরও কমপক্ষে পাঁচ চিকিৎসক মারা গেছেন।
রাজধানীসহ সারাদেশে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে করানা রোগীদের চিকিৎসা প্রদান করতে গিয়ে এক হাজার ৩৭ চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক রাজধানী ঢাকার।
এফডিএসআর-এর প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ডা. শাহেদ ইমরান আলাপকালে জানান, সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা ও মৃত্যু ঝুঁকি জেনেও চিকিৎসকরা ফ্রন্টলাইন ফাইটার হিসেবে করোনা রোগীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত রয়েছেন।
তিনি জানান, করোনায় আক্রান্ত এক চতুর্থাংশ চিকিৎসক অর্থাৎ আড়াই শতাধিক চিকিৎসক ইতিমধ্যেই সুস্থ হয়ে পুনরায় রোগীর সেবায় নিয়োজিত হয়েছেন। পরিবার-পরিজনকে দূরে রেখে তারা হাসপাতাল ও হোটেলে দিন কাটাচ্ছেন।
এফডিএসআর সূত্রে জানা গেছে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া প্রথম চিকিৎসক হলেন— সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মঈন উদ্দিন। গত ১৫ এপ্রিল রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।
এরপর গত ৩ মে সন্ধ্যা ৬টার দিকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. কর্নেল (অব.) মো. মনিরুজ্জামান। গত ১৩ মে একই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান অধ্যাপক ডা. আবুল মোকারিম।
১৮ মে মারা যান ডা. আজিজুর রহমান রাজু, ২২ মে মারা যান মৌলভীবাজারের সাবেক সিভিল সার্জন ডা. এমএ মতিন, একই দিন মারা যান ডা. কাজী দিলরুবা খানম, ২৬ মে মারা যান সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. আব্দুর রহমান, গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. আমিনা খান, ২৭ মে মারা যান অধ্যাপক ডা. মোশাররফ হোসেন, ৩০ মে মারা যান ডা. সাইদুর রহমান।
১ জুন মারা যান যক্ষ্মারোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ওয়াহিদুজ্জামান আকন্দ বাবলু, ২ জুন মারা যান প্রখ্যাত ইউরোলজিস্ট ডা. মঞ্জুর রশীদ চৌধুরী, ৩ জুন মারা যান চট্টগ্রামের মেরিন সিটি মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক (মেডিসিন) ডা. এহসানুল করিম। একই দিনে মারা যান ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ মহিউদ্দীন ও ডিজি হেলথের অবসরপ্রাপ্ত ইভালুয়াটার অফিসার ডা. একেএম ওয়াহিদুল হক।
সর্বশেষ মারা যান ফরেনসিক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. হাবিবুর রহমান ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ইমারজেন্সি মেডিকেল অফিসার ডা. মুহিদুল হাসান এবং বিএসএমএমইউয়ের ইউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. গোলাম কিবরিয়া।
আর করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া পাঁচ চিকিৎসক হলেন— অধ্যাপক ডা. মাহবুবুল আলম, অধ্যাপক (অব.) আনিসুর রহমান, ডা. সারওয়ার ইবনে আজিজ, ডা. জাফর রুমি ও ডা. তাজউদ্দিন।
এফডিএসআরের অভিযোগ, নিম্নমানের মাস্ক, পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইকুয়েপমেন্ট (পিপিই) এবং যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাবেই স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত হচ্ছেন।
সংগঠনটির নেতাদের আশঙ্কা, বৈশ্বিক এ মহামারির ফ্রন্ট লাইন যোদ্ধা চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সার্বিক নিরাপত্তাসহ যাবতীয় বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে নিশ্চিত করা না হলে, সারাদেশের স্বাস্থ্যখাতে চরম বিপর্যয় সৃষ্টির সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।