দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ক্রমাগতভাবে বাড়তে থাকায় প্রান্তিক পর্যায় থেকে নমুনা সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারদের (সিএইচসিপি) দিয়ে নমুনা সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এদের দিয়ে নমুনা সংগ্রহে প্রত্যাশিত ফল না পাওয়ার শঙ্কা আছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, করোনা রোগীর নমুনা সংগ্রহ অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া। করোনা রোগীর নাক এবং গলার ভেতর থেকে নমুনা সংগ্রহকারীদের এনাটমি ও ফিজিওলজি বিষয়ে জ্ঞান থাকা আবশ্যক। নমুনা সংগ্রহকারীদের এই জ্ঞান না থাকলে রোগীর ক্ষতি হতে পারে এবং নমুনা সংগ্রহকারী নিজেও করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন। এছাড়া এদের একাডেমিক সনদ এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ল্যাবরেটরি কাজের কোনো প্রশিক্ষণও নেই। এতে নমুনা পরীক্ষার ফল ভুল আসতে পারে। রোগটি আরও বেশি এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে মনে করেন।
এ প্রসঙ্গে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, রোগীদের নমুনা সংগ্রহ অত্যন্ত জটিল কাজ। এক্ষেত্রে যাদের এ ধরনের কাজের বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই তাদের মাধ্যমে নমুনা সংগ্রহ করলে তাতে সঠিক ফল পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
বৃহস্পতিবার এ সম্পর্কে একটি চিঠি ইস্যু করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট বিভাগ। স্বাস্থ্য অধিদফতরের কমিউনিটি বেইজড হেলথ কেয়ারের লাইন ডিরেক্টর সহদেব চন্দ্র রাজবংশী চিঠিতে বলেন, ‘কমিউনিটি ক্লিনিক লেভেলে করোনার নমুনা সংগ্রহের প্রয়োজন হতে পারে।’ চিঠিতে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কর্মকর্তাদের গাইডলাইন অনুযায়ী একদিনের প্রশিক্ষণ দেয়ার অনুরোধ করা হয়। এ চিঠি জারির পর সংশ্লিষ্ট মহলে দেখা দিয়েছে আলোচনা-সমালোচনা।
দেশের করোনা প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর থেকেই করোনা শনাক্তে রোগীদের নমুনা সংগ্রহ (রক্ত এবং নাক ও গলা থেকে লালা) পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আসছে সরকারি হাসপাতালে কর্মরত মেডিকেল টেকনোলজিস্টরা। সরকারি হাসপাতালে কর্মরত মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের দিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে স্বল্প পরিসরে করোনা রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্ভব হলেও বর্তমানে রোগীর সংখ্যা এবং পরীক্ষা কেন্দ্র বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদেরকে দিয়ে সুষ্ঠুভাবে এ কাজ অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
অপরদিকে করোনা রোগীদের পরীক্ষায় নিয়োজিত বেশ কয়েকজন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন এবং অনেকে কোয়ারেন্টিনে আছেন। সরকারি পর্যায়ে কর্মরত সীমিত সংখ্যক মেডিকেল টেকনোলজিস্ট দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী ১ জন চিকিৎসকের বিপরীতে ৫ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট থাকার কথা থাকলেও দেশে চিকিৎসক আছে প্রায় ৭০ হাজার, অন্যদিকে মেডিকেল টেকনোলজিস্টের পদ সর্বসাকল্যে ৯ হাজার। খোঁজ নিয়ে জানা যায় ১০ বছর ধরে নিয়োগ না হওয়ায় টেকনোলজিস্টের কয়েক হাজার পদ শূন্য আছে।
অপরদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়াধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ৩ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল টেকনোলজি (ল্যাবরেটরি) কোর্স সম্পন্ন করা ১৫ হাজার প্রশিক্ষিত মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের এ কাজে না লাগিয়ে কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারদের দিয়ে নমুনা সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়ার ফলে করোনা রোগীর নমুনা সংগ্রহ ও সঠিক রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরির আশঙ্কা রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারদের দিয়ে নমুনা সংগ্রহের যে উদ্যোগ নিয়েছে তাদের চিকিৎসাসেবা সংক্রান্ত কোনো একাডেমিক সনদ এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ল্যাবরেটরি কাজের কোনো প্রশিক্ষণও নেই। করোনা রোগীর নমুনা সংগ্রহ সঠিকভাবে করা না হলে পরীক্ষার ফলাফল পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। যার ফলে করোনা রোগী শনাক্তকরণে জটিলতা তৈরি হবে এবং লোকালয়ে ব্যাপকভাবে করোনা ছড়িয়ে পড়তে পারে।
বাংলাদেশ সিএইচসিপি অ্যাসোসিয়েশন কেন্দ্রীয় অ্যাডহক কমিটির আহ্বায়ক জাহিদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে অধিদফতরের আদেশ অনুযায়ী দেশের সকল কমিউনিটি ক্লিনিক সকাল ৮-১২টা পর্যন্ত সেবাদান অব্যাহত আছে। কিন্তু আমরা মারাত্মক ঝুঁকিতে আছি, সারা দেশের সব কমিউনিটি ক্লিনিকে বিএমআরসি ভবন থেকে কোনো প্রকার, গ্লাভস, মাস্ক, স্যানিটাইজার বা পিপিই প্রেরণ করা হয়নি। তাছাড়া এক ঘণ্টার একটি অনলাইন প্রশিক্ষণে এ ধরনের ঝঁকিপূর্ণ কাজ করা প্রায় অসম্ভব। তাছাড়া এক্ষেত্রে প্রোভাইডারদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। তাই নমুনা সংগ্রহে আরও বেশি প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারদের ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ১ দিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে লাগানোয় তাদের মধ্যে নানারকম উদ্বেগ/উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব মো. সেলিম মোল্লা যুগান্তরকে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতর যাদের দিয়ে করোনা রোগীর নমুনা সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা এই কাজে প্রশিক্ষিত ও যোগ্য নয়। মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাবরেটরি) এই কাজের যোগ্য। স্বাস্থ্য অধিদফতরের গৃহীত এই সিদ্ধান্ত সঠিক এবং বাস্তবসম্মত নয়।