ডিআইজি হাবিবুর রহমানের গবেষণাধর্মী ‘ঠার : বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা’ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ভাষার মাসেই অনাড়ম্বর এক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে মোড়ক উন্মোচিত হয়েছে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান, বিপিএম (বার), পিপিএম (বার) এর রচিত ‘ঠার : বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা’ গবেষণাধর্মী গ্রন্থের। বিশিষ্ট গবেষক ও ঋদ্ধ লেখক হাবিবুর রহমান রচিত বাংলাদেশের বেদে জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা বিষয়ক গবেষণাধর্মী গ্রন্থ ‘ঠার : বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা’। বাংলা ভাষায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে এ ধরনের প্রয়াস দেশে এই প্রথম। ভাষার মাসে এই আনন্দটুকু সবার সাথে ভাগ করে নিতেই মূলতঃ এই প্রয়াস। মঙ্গলবার (২২ ফেব্রæয়ারি ২০২২) বিকাল সাড়ে ৩ টায় বাংলা একাডেমির আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে একটি প্রকাশনা উৎসবে এ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেড বইটির মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। বইটির মোড়ক উন্মোচনের আগে এ গ্রন্থের লেখক ডিআইজি হাবিবুর রহমান, বিপিএম (বার), পিপিএম (বার)-কে ফুল দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয় এবং তাকে উত্তরীয় পরিয়ে দেওয়া হয়। বাংলা একাডেমির আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে এ গ্রন্থের উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কবি ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক কামাল চৌধুরী। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক কবি ও লেখক মিনার মনসুর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান। মুখ্য আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কথা সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ সংগঠক ও নাট্যজন অধ্যাপক ড. রতন চৌধুরী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি, বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। প্রধান অতিথির বক্তব্যে কবি ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক কামাল চৌধুরী বলেন, অন্তরের ভিতর থেকে তাগিদ না থাকলে ‘ঠার : বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা’ গ্রন্থ রচনা করা সম্ভব না। পার্টিসিপেশন অবজারভেজন মেথড অনুযায়ী হাবিবুর রহমান বইটি লিখেছেন। একজন গবেষক যখন কোনো বিষয়ে গবেষণা করেন তখন তার গবেষণার বিষয়ের খোলস ছেড়ে ভেতরে ঢুকতে হয়। আর এই কাজটি হাবিবুর রহমান করেছেন। তিনি একেবারে বেদে সম্প্রদায়ের মধ্যে ঢুকে গিয়ে তাদের ভাষাকে পর্যবেক্ষণ করে গ্রন্থটি রচনা করেছেন, যা পুরোপুরি পার্টিসিপেশন অবজারভেশনের মধ্যে পড়ে। এটি একটি ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষা। বিশ্বে প্রতি ১৫ মিনিটে একটি করে ভাষা বিলুপ্ত হচ্ছে। এখন থেকে আমরা যদি এর সংরক্ষণ না করি অচিরেই অনেক ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ‘ঠার : বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা’ গ্রন্থের ভাবনা ও প্রস্তাবনা তুলে ধরে বইয়ের লেখক ডিআইজি হাবিবুর রহমান বলেন, ওদের (বেদে জনগোষ্ঠীকে) হিংসা করবেন না, ওরাও মানুষ। হাবিবুর রহমান তার বক্তব্যে আবারও প্রমান করলেন তিনি কেন অনেকের চাইতে আলাদা। তিনি নিজে কাঁদলেন এবং সমবেত হাজার হাজার মানুষকে কাঁদালেন। তার বক্তব্যে তিনি মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা, মমত্ববোধ, দায়িত্ব, দায়বদ্ধতা রয়েছে তা নতুন করে তুলে ধরেছেন। বেদে সম্প্রদায়ের ভাষা ‘ঠার’ নিয়ে লিখতে গিয়ে শুরুতে বেদে সম্প্রদায়ের খুব কাছাকাছি চলে আসি। জানতে পারি বেদে সম্প্রদায়ের মানুষেরা মাদক বিক্রি করে। তারা সাপ খেলা দেখানোর ছলে মিয়ানমার থেকে আসা কক্সবাজারের উখিয়া থেকে ইয়াবা নিয়ে ট্রেনে করে কমলাপুর পর্যন্ত এসে তাদের আস্তানায় পাড়ি জমাতো। এরপর সেখান থেকে চলতো মাদক বিক্রি। আমি তাদের সম্প্রদায়ের ১৭ জন সর্দারের সাথে কথা বলেছি। তারা অফিসে এলে বসতে বললে ফ্লোরের ওপর বসে যায়। এরপরে তাদের চেয়ারে বসতে বলি এবং এটাই ছিলো তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে চেয়ারে বসা। ডিআইজি হাবিবুর রহমান বলেন, তারা স্বীকার করেছিল নদী না থাকা, সাপ খেলায় মানুষের আগ্রহ না থাকা ও তাবিজ না নেওয়ায় তারা মাদকে পা বাড়ায়। এরপরে যখন তারা নিজেরাই কথাবার্তা বলে তখন আমি বুঝতে পারি তাদের একটা নিজস্ব ভাষা আছে। আমি কৌতূহলের বশেই তাদের ভাষা নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী হয়ে যাই। তিনি আরো বলেন, গবেষণাটি চালাতে গিয়ে তাদের ভাষা ‘ঠার’ নিয়ে তেমন কোনো লেখা বা বই পাইনি। দুই-একটা বই যদিও পেয়েছিলাম সেখানে ‘ঠার’ ভাষা সম্পর্কে খুবই কম তথ্য ছিলো। বইগুলোতে বেদে সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রা নিয়েই বলা ছিলো বেশি। তেমন কোনো উপাদান না পেয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে আবেদন করি ‘ঠার’ ভাষা যেন হারিয়ে না যায় এবং এটাকে সংরক্ষণের বিষয়ে। তারা আমাকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছেন। প্রকাশনা উৎসবে সভাপতি সেলিনা হোসেন তার সমাপনী বক্তব্যে বলেন, ভাষার মাস একুশে ফেব্রæয়ারি। এ মাসেই ‘ঠার : বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা’ প্রকাশিত হওয়ায় ডিআইজি হাবিবুর রহমানকে ধন্যবাদ জানাই। তিনি জ্ঞান, শ্রম ও শ্রদ্ধা দিয়ে এই বইটি রচনা করেছেন। এ বইটি বেদে জনগোষ্ঠীর নিকট উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। সাংবিধানিকভাবে এদের ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আমরা আমাদের ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছি। এই বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষার জন্য তাদের জীবন উৎসর্গ করতে হবে না। এছাড়াও মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরুল হাসান শায়ক, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ, শিক্ষক, কবি ও সাহিত্যিক সহ সুশীল সমাজের গণ্যমান্য-ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। প্রসঙ্গত গ্রন্থটি একুশের বইমেলায় পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্সের ২৭নং প্যাভিলিয়ন সহ দেশের অভিজাত লাইব্রেরীগুলোতে পাওয়া যাবে বলে জানান প্রকাশনা কর্তৃপক্ষ।



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked as *