ঈদের কেনাবেচা শেষ করোনায়
প্রতি বছর ঈদকে কেন্দ্র করে সবচেয়ে বড় প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন দেশের পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা। কারণ ঈদ মানেই নতুন পোশাক। বাঙালির ঘরে ঘরে ছেলে-বুড়ো, তরুণ-তরুণী, মা-বোন সবার জন্য চাই নতুন পোশাক। ফলে ঈদের এক মাসেই বছরের বাকি ১১ মাসের সমান বেচাকেনা হয়। ১৭ কোটি মানুষের দেশে ঈদ উপলক্ষে কয়েক হাজার কোটি টাকার পোশাকের চাহিদা থাকে। শবেবরাত থেকে শুরু হয়ে এই বেচাকেনা চলে ঈদের আগের রাত পর্যন্ত। এ জন্য ঈদ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায়ীদের হাসিও চওড়া হতে থাকে। তবে এ বছর করোনাভাইরাসের কারণে ঈদবাজারের পরিবেশ ঠিক উল্টো। লকডাউনের বন্দিদশায় আটকা পড়েছে ঈদেরকেনাবেচা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ঈদ যত কাছে আসছে, ব্যবসায়ীদের কপালের ভাঁজ তত বাড়ছে।
গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমিত রোগী চিহ্নিত হয়। এ ভাইরাসের বিস্তার রোধে গত ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। ওই সময় থেকে দেশব্যাপী লকডাউন চলছে। মানুষের যাতায়াত সীমিত করে ঘরে থাকার অনুরোধ করা হচ্ছে। যানবাহন চলাচল, কলকারখানা, দোকানপাট বন্ধ। জরুরি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও ওষুধের দোকান ছাড়া অন্য সব দোকানই বন্ধ। সাধারণত মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। প্রতিদিনই দেশে ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও। ফলে কবে নাগাদ সবকিছু স্বাভাবিক হবে তা অনিশ্চিত। এমন পরিস্থিতিতে আসছে ঈদ। এ অবস্থায় ঈদ নিয়ে ব্যবসায়ীদের আশা একরকম হতাশায় পরিণত হয়েছে।
দেশে পোশাকের বাজার কত, কত মানুষ উৎপাদন, সরবরাহ, বিপণনে জড়িত তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। তবে ১৭ কোটি মানুষের দেশে বাজার যে বিশাল এবং এর সঙ্গে লাখ লাখ মানুষ জড়িত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কেউ সুতা বানান, কেউ সুতা থেকে কাপড় বানান, কেউ কাপড় থেকে পোশাক বানান, কেউ কাপড় রং করেন, কেউ পোশাকের বিজ্ঞাপন করেন, কেউ পোশাকের মোড়ক সরবরাহ করেন, কেউ পাইকারি বিক্রি করেন তো কেউ খুচরা বেচেন- এমন হরেক রকম কাজ রয়েছে পোশাককে কেন্দ্র করে। আবার বিদেশ থেকে পোশাক আমদানি করেও বিক্রি করেন একশ্রেণির ব্যবসায়ী। অন্যান্য বছর শবেবরাতের পর থেকেই ঈদের কেনাবেচা শুরু হলেও এ বছর সবই বন্ধ। সবাই হাত গুটিয়ে বসে আছেন।
দেশের পোশাকের বাজারের বড় সরবরাহ হয় ঢাকার পাশের কেরানীগঞ্জ থেকে। এখানকার হাজার হাজার কারখানা জিন্স ও গ্যাবার্ডিন কাপড়ের শার্ট, প্যান্ট, পাঞ্জাবি, ফতুয়া,সালোয়ার-কামিজ ও বাচ্চাদের হরেক রকম পোশাক তৈরি করে দেশের বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে। আবার বিভিন্ন জেলার ছোট ছোট ব্র্যান্ড যাদের একটি বা দুটি শোরুম রয়েছে, তারাও এখান থেকে নিজস্ব ডিজাইন ও কাপড়ে পোশাক বানিয়ে নেয়। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, নরসিংদী থেকে শাড়িসহ বিভিন্ন ধরনের পোশাক আসে বাজারে। রাজধানীর ইসলামপুর কাপড় ও তৈরি পোশাকের বড় পাইকারি বাজার। যশোর, কুষ্টিয়া, জামালপুর, সিলেটসহ বিভিন্ন জেলার কিছু কারিগর স্থানীয় কিছু ব্র্যান্ডকে বিভিন্ন ধরনের পোশাক বানিয়ে সরবরাহ করে। আবার কিছু ব্র্যান্ড রয়েছে যাদের রয়েছে নিজস্ব কারখানা। সব পর্যায়ে বর্তমানে কার্যক্রম বন্ধ। বিক্রি করার ব্যবস্থা না থাকায় কেউ কারও কাছ থেকে পণ্য কিনছেন না।
ঢাকা মহানগর দোকান মালিক সমিতির সভাপতি তৌফিক এহসান সমকালকে বলেন, ঈদ সারাদেশে পোশাক ব্যবসায়ীদের কাছে বড় আকর্ষণ। কিন্তু এ বছর তা হতাশায় রূপান্তরিত হয়েছে। ঢাকা মহানগরে আড়াই লাখ দোকান রয়েছে। ইতোমধ্যে এসব দোকান মালিকরা কোনো ধরনের ব্যবসা না করে কর্মীদের বেতন, দোকান ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিল বাবদ তিন হাজার কোটি টাকার পুঁজি হারিয়েছেন। এ ছাড়া কাপড় থেকে শুরু করে পাইকারি ব্যবসায়ী সবাই হাত গুটিয়ে বসে আছেন। এতে লাখ লাখ ব্যবসায়ী ও কর্মী অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন।
রাজধানীর পাশ দিয়ে বয়ে চলা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে কেরানীগঞ্জের আগানগর ও শুভাঢ্যা-কালীগঞ্জ এলাকা। গত কয়েক বছর ধরে এ এলাকায় হাজার হাজার কারখানা গড়ে উঠেছে, যেগুলো মূলত অভ্যন্তরীণ বাজারের জন্য পোশাক তৈরি করে। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, অভ্যন্তরীণ বাজারের তৈরি পোশাকের বড় অংশের জোগান দিচ্ছে এই আগানগর ও শুভাঢ্যার পোশাক কারখানাগুলো। প্রতি বছর রমজানের আগে কাজের চাপে ঘুম হারাম হয়ে যায় কেরানীগঞ্জের এই পোশাকপল্লীর কর্মীদের। কিন্তু এ বছর পরিস্থিতি ভিন্ন। অন্যান্য বছর যে সময়ে দম ফেলার সুযোগ পেতেন না ব্যবসায়ী ও কর্মীরা, এ বছর সেই সময়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই তাদের। লাভের আশায় অন্যান্য বছর যাদের চোখ ঝলমল করত, এ বছর সেই চোখগুলোই লোকসানের ভয়ে ঝাপসা হয়ে আসছে।
কেরানীগঞ্জের তৈরি পোশাক ব্যবসায়ী ও দোকান মালিকরা জানিয়েছেন, এলাকায় প্রায় সাত হাজার তৈরি পোশাকের কারখানা রয়েছে। আর ৯ থেকে ১০ হাজার দোকান রয়েছে, যারা পাইকারি পোশাক বিক্রি করে। এসব কারখানা ও দোকানে কর্মসংস্থান হয়েছে দুই থেকে আড়াই লাখ মানুষের। দেশের তৈরি পোশাকের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই সরবরাহ হয় কেরানীগঞ্জ থেকে। সারাদেশের নিম্ন আয়, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত ক্রেতাদের চাহিদা বিবেচনা করে এখানে পোশাক তৈরি হয়। রমজান শুরুর দুই মাস আগে থেকেই ঈদ উপলক্ষে পোশাক বানানো হয়। পোশাক বিক্রি হয় শবেবরাতের পর থেকে। চলে ২০ রোজা পর্যন্ত। করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে সরকারি বন্ধ ঘোষণার পর থেকে কেরানীগঞ্জের দোকানপাট বন্ধ। ফলে ঈদ উপলক্ষে তৈরি করা কোনো পোশাকই বিক্রি হয়নি।
আগানগর আলম টাওয়ারের লক্ষ্মী পোলা গার্মেটের মালিক মো. মোস্তাফিজুর রহমান সমকালকে বলেন, এ সময় কারখানাগুলোতে বিরামহীন কাজ চলত। এ বছর তা হচ্ছে না। ফলে শত শত কোটি টাকার লেনদেন বন্ধ রয়েছে। জেলা পরিষদ মার্কেটের মুসলিম গার্মেন্টের স্বত্বাধিকারী হাজি মুসলিম ঢালী বলেন, এ বছর বৈশাখী পোশাক বিক্রি হয়নি। ঈদের বেচাকেনাও অনিশ্চিত। আশা গার্মেন্টের স্বত্বাধিকারী মো. জামিলুর রহমান বলেন, ব্যবসায়ীরা ব্যাপক সংকটে পড়েছে। পশ্চিম আগানগরের গার্মেন্ট ব্যবসায়ী ও দোকান মালিক বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি ফারুক হোসেন মিঠু বলেন, ঈদের সময় যে চাহিদা থাকে তার ৪০ শতাংশ পোশাক কারখানাগুলোয় তৈরি হয়েছে। এর মধ্যেই সব বন্ধ হয়ে গেছে। কেরানীগঞ্জ গার্মেন্ট ব্যবসায়ী ও দোকান মালিক সমবায় সমিতির সভাপতি স্বাধীন শেখ বলেন, এ বছর উৎসবে কোনো বেচাকেনা নেই।
অনেকে আছেন নিজের পছন্দমতো পোশাক পরেন। এ জন্য বাজার থেকে কাপড় কিনে নিয়ে যান দর্জির দোকানে। ঈদের আগে এ খাতেও ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চলে। বেচাকেনা বাড়ে ছিটকাপড়ের। এখন এ সবই অচল।
রাজধানীর মানিকনগরের আবরণী টেইলার্সের মালিক সোহাগ বলেন, প্রতিবছর শবেবরাতের আগেই ব্যাপক পরিমাণে অর্ডার হয়। পাঁচটি মেশিনে চাঁদরাত পর্যন্ত টানা কাজ চলে। এ বছর তার কিছুই নেই। কর্মীরা সবাই ছুটিতে বাড়িতে গেছেন। ইসলামপুরের ব্যবসায়ী শিমুল বলেন, দোকান বন্ধ থাকলে বিক্রি হবে কীভাবে?